সবুজ দার্শনিকরা পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাদের সূক্ষ্ম উপলব্ধিগুলো বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। অনেকে আবার ভাবতে পারেন পরিবেশের আবার দর্শন আছে নাকি? দর্শন, তত্ত্ব ও তথ্য ছাড়া বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো কিছুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক নয়। পরিবেশকে কীভাবে অধ্যয়ন করতে হবে এবং পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিনির্মাণে সবুজ দর্শনের ধারণাও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সবুজ দর্শন প্রথমত পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের মানসিকতা ও চিন্তাধারার পরিবর্তন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাদামাটাভাবে সবুজ দর্শন হলো এমন এক দার্শনিক চিন্তা, যা পরিবেশবিষয়ক নৈতিকতা বিবেচনা করে প্রকৃতির কাছে পরিবেশ নৈতিকতার মূল্য নির্ধারণ করে এবং পরিবেশ নৈতিকতা বা সবুজ নৈতিকতার তাৎপর্যটি পরীক্ষা করে দেখে।
সবুজ দর্শনের বাস্তবায়নে সবুজ রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সবুজ দর্শন এমন একটি দার্শনিক চিন্তা; যা এই দলবদ্ধ জনগোষ্ঠীর নৈতিক পরিবর্তন ঘটাবে। ফলে তাদের সঙ্গে পরিবেশের এক নতুন সম্পর্ক তৈরি করবে। সবুজ দর্শনকে কার্যকর করার জন্য এমন এক ধরনের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণী গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে, যাদের বলা হবে সবুজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা সবুজ রাজনৈতিক দল।এ রাজনৈতিক দল পরিবেশসংক্রান্ত নিয়মনীতি প্রণয়ন করবে এবং এমন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করবে যেখানে সবুজ দর্শন, সবুজ রাজনীতির চর্চা ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। সেখানে সাধারণ নাগরিকরাও সবুজ চিন্তাধারার চর্চা করবে এবং সবুজ রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ক্ষমতার আসনে আসীন করবে।
সবুজ দর্শন বা পরিবেশ দর্শনকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে পরিবেশ ও মানুষকেন্দ্রিকতা ধারণার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পরিবেশ সমস্যা সমাধানে বা পরিবেশের সঙ্গে মানবজাতির সম্পর্ক গঠনে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কি পরিবেশকে গুরুত্ব দেবে নাকি পরিবেশের ওপর মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেবে, তা বিশ্লেষণ করার জন্যই পরিবেশ ও মানবকেন্দ্রিকতার ধারণার জন্মলাভ করে। মানুষকেন্দ্রিকতার মূল অর্থ হলো মানুষকে এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বা মানুষের স্বার্থকে সবকিছুর ওপর ভাবার একটি উপায়ের নাম। অর্থাৎ এ ধারণায় পরিবেশের তুলনায় মানুষের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অন্যদিকে পরিবেশকেন্দ্রিকতা বলতে মানুষকে পরিবেশের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ ও পরিবেশ এক অবিচ্ছেদ্য অনুসর্গ। এ ধারণায় শুধু মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাই গুরুত্ব পায় না, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ছাড়া যেসব প্রাণ আছে; তারও গুরুত্ব উপলব্ধি করা হয়।তাই এমন একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে এ ধরনের চিন্তাধারা, নিয়মনীতি ও আইনকানুন তৈরি করা হবে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র সে ধরনের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলবে যেখানে মানুষ ও পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। সবুজ দর্শন ও সবুজ চিন্তাকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য মানুষ ও পরিবেশের মূল্য কী হওয়া উচিত, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কোনো কিছু কতটুকু মূল্যবান তা নির্ভর করে ওই জিনিসটা আমরা কতটুকু মূল্য দিতে রাজি। এই মূল্য নির্ধারণে তিনটি ডাইমেনশন উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমটি হলো যন্ত্রের মূল্য: একটি যন্ত্রের মানের ওপর নির্ভর করে যন্ত্রটির মূল্যায়ন। কারণ যন্ত্র মানুষকে কাজ করতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ একটি ওয়ার্ড প্রসেসর আমার কাছে মূল্যবান, কারণ এর সাহায্যে আমি লিখতে পারি। আবার যদি আমার লেখার প্রয়োজন না হয় তাহলে এটি আমার কাছে মূল্যহীন। ওয়ার্ড প্রসেসর শুধু তাদেরই কাছে মূল্যবান যারা এটি ব্যবহার করতে চান।
অন্য ডাইমেনশন হলো কোনো কিছুর সহজাত মূল্য: এমন কিছু জিনিস আছে যার মূল্য সহজাত। কোনো কর্মের উপায় হিসেবে এটিকে মূল্যবান মনে করা হয় না। এটি মূল্যবান কারণ এটি মূল্যবান। যেমন একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান যদিও এটি আমাদের সরাসরি ওয়ার্ড প্রসেসর মতো সহযোগিতা করে না। এটি এমন একটি বিষয়, যা আমরা নিজেরাই মূল্যবান মনে করি।
সর্বশেষ ডাইমেনশনটি হলো অন্তর্নিহিত মূল্য: অন্তর্নিহিত মূল্যের মৌলিক অর্থ হলো সহজাতভাবে এটি মূল্যবান। এ মূল্য নির্ধারণ করার জন্য কোনো আবেদনের প্রয়োজন হয় না। যাদের কাছে এটি মূল্যবান তাদের কাছে সবসময় মূল্যবান। স্বাধীনভাবে যে কেউ এটিকে মূল্যবান মনে করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্য নির্ধারণের এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পরিবেশের মূল্য কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে। পরিবেশের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিন ধরনের চিন্তাধারায় কার্যকর হতে পারে। কেউ মনে করতে পারেন যে পরিবেশের শুধু যান্ত্রিক মূল্য রয়েছে। আবার অনেকে মনে করতে পারেন পরিবেশের সহজাত মূল্য আবার কারও কাছে পরিবেশের অন্তর্নিহিত মূল্য রয়েছে। যারা পরিবেশের শুধু যান্ত্রিক মূল্য নির্ধারণ করেন, তারা সঠিকভাবে পরিবেশ বা গ্রিন দর্শনকে ভালোভাবে বুঝতে ও পরিবেশের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেননি। তাদের কাছে পরিবেশ মূল্যবান যন্ত্রের মতো, যন্ত্র যেরকম যতক্ষণ উপকারে আসে ঠিক ততক্ষণই মূল্যবান আর যাদের উপকারে আসে শুধু তাদের কাছে মূল্যবান। কিন্তু প্রকৃত অর্থে পরিবেশের মূল্য কোনো যান্ত্রিক মূল্য নয়। পরিবেশের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে সহজাত ও অন্তর্নিহিতভাবে। সবার কাছে, স্বাধীনভাবে, সবাই পরিবেশকে মূল্য দিতে জানতে হবে। এটি হচ্ছে গ্রিন দর্শনের মূল বক্তব্য। আমরা যদি পরিবেশকে যন্ত্র মনে করি এবং এর সহজাত ও অন্তর্নিহিত মূল্যকে অবহেলা করি তাহলে পরিবেশকে আমরা সেরকম গুরুত্ব দেব না এবং পরিবেশ বিপর্যয় করার কাজে লিপ্ত থাকব। গ্রিন দর্শন আমাদের পরিবেশের সঠিক মূল্য দিতে শেখাবে।
গ্রিন দর্শন গ্রিন তত্ত্ব তৈরি করবে; যে তত্ত্ব গ্রিন সমাজ, গ্রিন নাগরিক ও গ্রিন সরকার, সর্বোপরি গ্রিন রাষ্ট্র তৈরি করবে। গ্রিন দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গ্রিন চিন্তাধারা তৈরি করা যাবে, যে চিন্তাধারায় মেনে নেওয়া হয় যে, বর্তমান পরিবেশ সংকটের মৌলিক কারণ হচ্ছে মানুষের পরিবেশের প্রতি বিরূপ আচরণ। আর এ বিরূপ আচরণকে মানুষ সচরাচর বৈধতা দেয় তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। এখানে এটিকে বৈধতা দেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষকেন্দ্রিকতা। গ্রিন দর্শন ও তত্ত্ব বা চিন্তাধারার মৌলিক যুক্তি মানুষকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে। মানুষকেন্দ্রিকতায় বিশ্বাস করা হয় যে, শুধু মানুষের জন্য, মানুষকে কেন্দ্র করে, মানুষের প্রয়োজনে মহাবিশ্ব। একচেটিয়াভাবে মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে স্থাপন করা হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। গ্রিন দর্শন এবং চিন্তাধারায় তা সমর্থন করে না।
মানুষকেন্দ্রিকতায় মনে করা হয় যে, শুধু মানবসমাজেরই অন্তর্নিহিত মূল্য রয়েছে, সেজন্য তাদের আনন্দ-বেদনা, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে পরিবেশের অন্তর্নিহিত মূল্যকে অস্বীকার করা হয়। মানুষ ছাড়া অবশিষ্ট প্রকৃতির যান্ত্রিক মূল্য নির্ধারণ রয়েছে বলে মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাস করা হয়। পরিবেশের অতটুকু মূল্যই স্বীকার করা হয় যতটুকু পরিমাণ তারা মানবজাতির উন্নতি সাধন করতে সক্ষম। প্রকৃতি বা পরিবেশের যে একটি অন্তর্নিহিত মূল্য আছে বা সহজাত মূল্য আছে, তা এখানে অস্বীকার করা হয়। তাই আমাদের গ্রিন দর্শন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বক্তব্য হচ্ছে—মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণ এবং মানব প্রকৃতির সহজাত ও অন্তর্নিহিত মূল্যকে স্বীকার করতে হবে। মানুষের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক বিনির্মাণে সবুজ দর্শন ও সবুজ নৈতিকতা কাজ করবে। রাজনীতি হবে সবুজ, রাষ্ট্র হবে সবুজ, নাগরিকরাও হবে সবুজ। পরিবেশ ও আমরা সমগুরুত্ব নিয়ে একই সঙ্গে বসবাস করব। তাহলে সবুজ দর্শন, সবুজ নৈতিকতা সফল হবে। ভালো থাকবে বিশ্ব, রাজনীতি ও রাষ্ট্র।
আমরা জানি, বাংলাদেশ চরমভাবে পরিবেশ বিপর্যয়-কবলিত একটি দেশ। আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২০৩০ সালে। আমাদের বর্তমান পরিবেশগত শিক্ষার প্রতি জোর দিলেও পরিবেশগত শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে গ্রিন এডুকেশন ও পরিবেশগত শিক্ষানীতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গ্রিন কনসেপ্টকে সামনে রেখে এডুকেশন সিস্টেম চালু করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চবি
সম্পাদক ও প্রকাশক- মোঃ সোহান মাহমুদ