

দেশে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা, সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনার বিচারসহ নানা ইস্যুতে বিএনপি ও নতুন প্রকাশিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই বাগযুদ্ধ চলছে। দল গঠনের আগেও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ‘জুলাই প্রোক্লেমেশন’সহ নানা বিষয়ে বিএনপির অমিল তৈরি হয়। সেই ধারাবাহিকতায় দল দুটির মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে দেশের রাজনীতি দিন দিন তপ্ত হয়ে উঠছে। বরাবরের মতো বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন, আর এনসিপি চায় আগে সংস্কার ও শেখ হাসিনার বিচার। এনসিপির গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি।
এনসিপি নেতারাও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলছেন। অন্যদিকে, বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও কড়া প্রতিক্রিয়া আসছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিচারের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়—এনসিপির নেতা সারজিস আলমের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট তাড়াতে গিয়ে নিজেরাই না ফ্যাসিস্ট হয়ে যাই। ফ্যাসিজমের জন্য আন্দোলন হয়নি। কেউ নিজের মতামত, আদর্শ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে, এটা হতে পারে না। আমি আমার মতামত প্রকাশ করতেই পারি। আমার মতামত আপনাকে মানতে বাধ্য করব, এটা হতে পারে না।’ সবমিলিয়ে বিএনপির সঙ্গে ছাত্রদের একটা দূরত্ব দেখা দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই—এটি যেমন সত্য, তেমনি ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর কিছু মৌলিক বিষয়ে এখন রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা সম্ভব না হলে দেশ আরও বড় সংকটে পড়ে যাবে, এটিও চরম সত্য। তাদের মতে, অনেকেরই ধারণা, আগামীতে একটি নতুন দলকে ক্ষমতায় আনতে সরকার নির্বাচন বিলম্ব করতে চায়। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রভাব ও চাপমুক্ত এবং সর্বোপরি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে কোনো নতুন দল, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত কোনো দল সর্বোচ্চ কতটি আসন পাবে, এমনকি দলের শীর্ষ নেতারাও জয়ী হতে পারবেন কি না—সে এক বিরাট প্রশ্ন। তা ছাড়া এই দ্বন্দ্বের ভেতর থেকে কী বেরিয়ে আসছে এবং এর পরিণতি কি আরেকটি বড় সংকটের দিকে যাত্রা, নাকি ইতিবাচক কিছু?
এমনটিও প্রশ্ন সচেতন মহলে।
বের করে নিয়ে আসতে বড় ধরনের সংস্কার এবং কোথাও কোথাও পরিবর্তন আনতেই হবে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশের দিন এনসিপি বলছে, দেশে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা হবে।
তবে এনসিপির নতুন ধারণা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এখন নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝি নাই কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝি নাই সেকেন্ড রিপাবলিক কী? কী বোঝায়, আপনারা বুঝেছেন কি না, জানি না। অর্থাৎ একটা অসিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। দয়া করে খেয়াল রাখবেন।’
গত মঙ্গলবার রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত ও দোয়া মোনাজাত করেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা। সেখানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক সারজিস আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাসিনার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয়। আমরা এই সরকারকে আমাদের জায়গা থেকে অনেকবার বলেছি, এই বিচার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় করতে হবে এবং যে সময়টুকু এই সরকারের আছে, নির্বাচনের আগেই খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। যতদিন না আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে না দেখছি, এই বাংলাদেশে কেউ যেন ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’ তার এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ প্রকাশ্যেও বেশ আলোচনা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যে কেউ যে কোনো কথা বলতেই পারে। কিন্তু সেটা পূরণের জন্য অবশ্যই জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে। এখানে ইলেকশন পেছানোর তো কোনো সুযোগ নাই। অলরেডি ডিসেম্বর ইজ টু লেইট। একেকদিন গণতন্ত্রহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ রকম একটা অবস্থা তো এক দিনও থাকার প্রয়োজন নেই। আমাদের অনেকের অনেক চাহিদা থাকতে পারে। সে চাহিদা পূরণের সময় তো এটা না।’
তবে বিএনপির সঙ্গে ছাত্রদের মতানৈক্যের এখানেই শেষ নয়। তার আগে গত ২৩ জানুয়ারি দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে শহীদ আসাদের ৫৬তম শাহাদাতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বেশকিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেদিন তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে নির্বাচনের সময়ে একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার হবে।’
বিএনপি মহাসচিবের ওই বক্তব্যে রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দেন জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি লেখেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে…।’ মির্জা ফখরুলের ওই বক্তব্যের বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমও তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ আখতার হোসেন বাদল কালবেলাকে বলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে সরকার ও ছাত্রনেতাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটি অব্যাহত থাকলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা, এমন দ্বন্দ্ব বা সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ কারও জন্যই কাম্য নয়। বরং গণতান্ত্রিকভাবে টেকসই উত্তরণের মাধ্যমে দেশে বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাগানো উচিত। সেজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সংস্কার ও বিচারের নামে নির্বাচন বিলম্ব করলে দেশ আরও বড় সংকটে পড়বে। কেননা, অন্তর্বর্তী সরকার খুব সফলতার সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মনে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করতে পারলে নির্বাচনের দাবিটি জোরালো হতো না।
তিনি আরও বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তা ছাড়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে সুবিধাভোগী অনেকেই হয় পলাতক, নয়তো চুপচাপ। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ যাতে বেকার না হয়, জীবন-জীবিকা যাতে অনিশ্চয়তায় না পড়ে, মানুষের জীবন যেন আগের চেয়ে কঠিন না হয়—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সে বিষয়েও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। ফলে এই মুহূর্তে উপদেষ্টা পরিষদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দক্ষদের নিয়োগ দেওয়া সরকারের উচিত বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক বাদল।অন্যদিকে, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল আসলাম আদিব বলেছেন, গণপরিষদ নির্বাচন চেয়ে আমরা জাতীয় নির্বাচন পেছাতে চেয়েছি, এমন ধারণা সঠিক নয়। আমাদের দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এরই মধ্যে বলেছেন, গণপরিষদ নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এটার জন্য কোনো নির্বাচনই পেছাতে হবে না। সরকার প্রস্তুতি নিলে দুটি নির্বাচনই একসঙ্গে ডিসেম্বরে বা জুন মাসে সম্ভব। তিনি বলেন, যদি সারা দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্ভব নাও হয়, তাহলে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলা-উপজেলায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে। এটা দরকার। কারণ প্রশাসনের প্রস্তুতি এবং সক্ষমতাও তখন আমরা যাচাই করতে পারব।