

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য এবং নিন্দনীয় সমস্যা হচ্ছে ধর্ষণ। কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনাচারে বাধ্য করাকেই ধর্ষণ বলা হয়। অতীতেও আমাদের দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়েছে, তবে তা ছিল অনেকটাই সীমিত পরিসরে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে কিছু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্ষণের যেসব সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকেই উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত করছে। কোনো দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করলে ধর্ষণ থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামাজিক অনাচার দেখা দেয়। মাত্র কয়েক মাস আগে যে ছাত্রসমাজ দেশ থেকে স্বৈরাচার বিতাড়িত করার জন্য সফল গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিল আজ তারাই আবারও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়ে রাস্তায় নেমেছে, এটা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা তাদের মাঠে নামতে বাধ্য করেছে।
যেভাবে ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কোনো বিবেকবান মানুষই নিশ্চুপ হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে না। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হলে কিছুদিন দেশে অরাজকতা বিরাজ করতে পারে। কিন্তু তাই বলে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করবে এটা কাম্য নয়, স্বাভাবিকও নয়। মাগুরায় আট বছরের নিষ্পাপ শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় পুরো জাতি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে।
কতটা অমানুষ হলে এমন ঘটনা কেউ ঘটাতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অধঃপতনের চিত্রই ফুটে ওঠে। দেশের আরো কোনো কোনো অঞ্চল থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে ধর্ষণ যেভাবে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে অতীতে আর কখনোই এমনটি হয়নি। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধের কারণগুলো আমাদের নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
বাংলাদেশে নানা কারণেই নারীদের পূর্ণ মাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ দমনের দাবিতে আন্দোলন করছে। এসব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষকবৃন্দও অংশ নিচ্ছেন। অর্থাত্ দেশে ধর্ষণবিরোধী এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মোতাবেক, ২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুলাই সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে ১০ হাজার ৭০৪টি। একই বছর আগস্ট-ডিসেম্বর সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ছয় হাজার ৮৬৭টি। আর ২০২৫ সালে জানুয়ারি মাসে নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি। গত বছর (২০২৪) জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার ৪৬৪টির অধিক ধর্ষণের মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। এই সময় ধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই আরো বেড়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুসারে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সাত মাসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে কল এসেছে ৩৪৮টি। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে জানিয়েছে, গত বছর (২০২৪) নারী ও শিশু নির্যাতনের দুই হাজার ৫২৫টি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সাত মাসে এক হাজার ৬৬৪টি এবং আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৮৬১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জনকে। ধর্ষিতা হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ছয়জন।
যথোপযুক্তরূপে এমনকি অফিসে-আদালতেও চালু করতে পারব না, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো নয়ই। টাকা যেখান থেকে আসে, ভাষাও সেখান থেকেই আসবে। টাকাই আসলে কথা বলে, অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে ওঠে তার গলার স্বর। সামাজিক বীররা বাংলা বলেন না বা যত কম বলেন, ততই বেশি পরিমাণে বীরের মর্যাদা পান—এই দৃশ্য আমরা অতীতে দেখেছি, ভবিষ্যতেও দেখতে থাকব, যদি না হঠাত্ করে সামাজিক বিপ্লব ঘটে যায়। দ্বিতীয়ত, অফিসে-আদালতে বাংলা চলছে, বাংলা ছাড়া আর কিছুই চলছে না—এই লোমহর্ষক ছবি দেশবাসীর জন্য বৈপ্লবিক কোনো মঙ্গল আপনা থেকেই বয়ে নিয়ে আসবে এমনও তো ভরসা হয় না। জেল-ফাঁসি তো মস্ত ব্যাপার, জরিমানার কথাটাই যদি ইংরেজিতে না এসে বাংলায় আসে, তাহলে আমরা যে আহ্লাদে একেবারে আটখানা হব এমন তো ভরসা রাখি না। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু সবই সমান তখন আমাদের কাছে। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেব কী করে? পাঠ্যপুস্তক কোথায়? কোথায় পরিভাষা? কে করবে অনুবাদ? এই সমস্ত উত্তেজিত প্রশ্নের অভ্যন্তরে আছে একটি শান্ত সিদ্ধান্ত, পাঠ্যপুস্তক দেশে লেখা হবে না, তাকে আনতে হবে বিদেশ থেকে, তার বিষয়বস্তু আপাদমস্তক বিদেশি, আবরণটাই শুধু স্বদেশি। ওইটুকুই। উচ্চশিক্ষা সব দিক দিয়েই বিদেশমুখো এবং বিদেশে তো বাংলার চল নেই।